জাপানের হিরোশিমা শহরে আমেরিকার আনবিক বোমা হামলা চালানোর সত্তর বছর পূর্তি হচ্ছে বৃহস্পতিবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর থেকেই আমেরিকানরা বলে আসছে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলা চালানো জরুরী হয়ে পড়েছিল। এভাবে তারা হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করেছিল।
অথচ জাপানের ওই দুই শহরে বোমার বিস্ফোরণ এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কেকো ওগুরা একজন হিরোশিমা সারভাইভার এবং এখন তিনি আমেরিকার ওই অযৌক্তিক বয়ানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
বিবিসির রুপার্ট উইঙ্গফিল্ড হায়েসের কাছে তিনি সেদিনের কথা স্মরণ করছিলেন।
আটাত্তর বছর বয়সী কেকো ওগুরা এখন চাইলে দারুণ একটি অবসর জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তার বদলে পারমানবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এই হিরোশিমা সারভাইভর এখন দারুণ ব্যস্ত। নিজের চোখে দেখা আনবিক বোমা হামলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছেন মানুষের মাঝে।
১৯৪৫ সালের ছয়ই অগাস্ট যখন প্রথম পারমানবিক বোমাটি বিস্ফোরিত হয়, তখন হিরোশিমার শহরতলীতে নিজের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কেকো।
তিনি বলেন, ”অবর্ণনীয় শব্দ আর তীব্র আলোকচ্ছটা ঘিরে ধরে আমাকে। আমি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাই। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আরো পরের দিকে আহত ভয়ার্ত মানুষেরা কেকোর বাড়ির আশপাশে জড়ো হতে থাকে।”
কোকো ওগুরা বর্ণনা করছিলেন, ”তাদের চামড়া খুলে খুলে পড়ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তারা হয়তো গায়ের সঙ্গে একটি চাদর বা অন্য কিছু জড়িয়ে আছে এবং ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলে সেটি ছিল তাদের গায়ের চামড়া এবং খুলে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে তারা ধরে রেখেছিল। হঠাৎ কেউ একজন আমার পা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, আমাকে পানি দাও। তারপর সবাই একসাথে বলতে শুরু করলো, পানি দাও, পানি দাও। আমি তখন আমাদের কুয়া থেকে পানি তুলে আনলাম, এবং তাদের খেতে দিলাম। বেশীরভাগই পানি পান করে আমাকে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু কয়েকজন পানি পান করার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো।”
এর অনেক বছর পর কেকো আমেরিকা সফরে যান, পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যাওয়া একজন হিসেবে তার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে। কিন্তু সেখানে যেসব আমেরিকানের সাথে দেখা হয় তার, তাদের সাথে কথা বলে এবং জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা সম্পর্কে তাদের ধারণা শুনে রীতিমত ধাক্কা খান তিনি।
কারণ তাদের সবার ধারণা, আণবিক বোমা হামলা করে তারা জাপানীদের বাঁচিয়েছে। এমনকি আমেরিকার কোন টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে বোমার শিকার মানুষদের নিয়ে কোন সংবাদ তিনি দেখতে পাননি।
বীভৎসভাবে দগ্ধ আহত-নিহত নারী ও শিশুদের বেশীরভাগ তথ্যচিত্র আমেরিকানরা গোপন করে রাখে এবং ১৯৮০র দশক পর্যন্ত এসব ভিডিও ও ছবি ক্লাসিফায়েড বা গোপন নথি হিসেবেই ছিল।
হিরোশিমার যে স্থানটিতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল পারমানবিক বোমা সেখানে এখন তৈরি হয়েছে পিস পার্ক। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন কিকো। এদের সবাই এই প্রথমবারের মতো একজন হিরোশিমা সারভাইভরের মুখোমুখি।
জামাল ম্যাডক্স বলছিলেন, ”আমাদের শেখানো হয়েছে যে, বিজ্ঞানের অসাধারণ একটি আবিষ্কার হিরোশিমার ওপর ফেলা হয়েছে, কয়েক মুহূর্তের একটি আলোকচ্ছটা তৈরি হয়েছে, আর তাতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এটা ছিল একেবারেই পরাবাস্তব ব্যাখ্যা। আমি যখন চিন্তা করি যে সেদিনের সেই দুঃস্বপ্ন আজো সেখানকার মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তখন আমি দারুণ দুঃখভারাক্রান্ত হই।”
আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্টই দায়িত্বে থাকাকালে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে যাননি। প্রেসিডেন্ট ওবামারও সত্তর বছর পূর্তির দিনটিকে হিরোশিমায় যাবার কোনও পরিকল্পনা নেই।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব তরফ থেকেই ভীতিকর সব ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করার জন্য জাপানের সমালোচনা করা যথাযথই বটে। কিন্তু আমেরিকার তরফ থেকে যে অস্বীকারের প্রবণতা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে তার বিচার করবে কে?